পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশ। বিজিএমইএর তথ্য মতে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা হবে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দরকার অসংখ্য দক্ষ মার্চেন্ডাইজার। আজকাল মার্চেন্ডাইজার হিসেবে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গড়ছেন অনেকেই। প্রতিষ্ঠান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভেদে মার্চেন্ডাইজারদের বেতন লাখখানেক পর্যন্ত হতে পারে।
স্নাতকধারী যে কেউ ৬ থেকে ১২ মাসের কোর্স করে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পাবেন। মার্চেন্ডাইজারদের কাজ মূলত বায়িং হাউস ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে।
কী কাজ?
বায়িং হাউসের মার্চেন্ডাইজাররা বিদেশি ক্রেতা বা বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রডাক্ট বিক্রি বা পোশাক তৈরির অর্ডার নেন। বিদেশি বায়ারকে কাঙ্ক্ষিত প্রডাক্টের কয়েকটি স্যাম্পল বা নমুনা দেখানো হয়। পাশাপাশি প্রডাক্ট তৈরির উপকরণ, মান, বৈশিষ্ট ও গুণাগুণ বায়ারের কাছে তুলে ধরা হয়। বায়ার সেম্পল দেখে পছন্দ করলে দামের ব্যাপারটি চূড়ান্ত করেন। এরপর প্রডাক্টের সংখ্যা, শিপমেন্টের সময় ও দরদাম উল্লেখ করে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়।
বায়ারের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে কি না, তা মার্চেন্ডাইজারকেই নিশ্চিত করতে হয়।
প্রডাক্ট তৈরি থেকে শুরু করে শিপমেন্ট পর্যন্ত পুরো কাজ মার্চেন্ডাইজারকেই দেখভাল করতে হয়।
চাহিদা অনুযায়ী কাপড় ও আনুষঙ্গিক পণ্য সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে নির্দিষ্টসংখ্যক পোশাক তৈরি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেলিভারি বা শিপমেন্ট করাই একজন মার্চেন্ডাইজারের কাজ।
যেসব দক্ষতা দরকার
ইয়র্ক গ্রুপের মার্চেন্ডাইজ ম্যানেজার গাজী সালাউদ্দিন হিমেল জানান, বায়িং হাউসগুলোই মূলত দেশের গার্মেন্টস-টেক্সটাইল এবং বিদেশি বায়ারদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দেশের বায়ায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, তাই মার্চেন্ডাইজারকে ইংরেজিতে কথোপকথন ও যোগাযোগে পারদর্শী হতে হয়। পাশাপাশি অন্য আরো যত ভাষা জানা থাকবে, প্রার্থীকে ততটাই যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আর কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে দরকারি কিছু কাজে দক্ষতা থাকতে হবে। যেমন—ই-মেইল পাঠানো, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা স্কাইপির ব্যবহার, ইমেজ ফরমেটে স্যাম্পল উপস্থাপন, দরকারি তথ্য জুড়ে দেওয়া ইত্যাদি।
নিয়োগ যেভাবে
অনলাইন জব পোর্টাল ও প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে সরাসরি সিভি জমা দেওয়ার সুযোগ থাকে। এরপর হয় সরাসরি ভাইভা, নয়তো প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার পর ভাইভার জন্য ডাকা হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে একাধিক ধাপে ভাইভা নেওয়া হয়। এশিয়ান গ্লোবাল সোর্সিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এমআইএফটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক গোলাম মাওলা জানান, এন্ট্রি লেভেলে নিয়োগে প্রার্থীর স্মার্টনেস ও ইংরেজিতে যোগাযোগের দক্ষতাই প্রথমে দেখা হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষ, টেক্সটাইল কিংবা অ্যাপারেলস পড়া প্রার্থীরাই অগ্রাধিকার পান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেফারেন্সের মাধ্যমে চাকরি হয়, তবে সেখানেও দক্ষতা প্রমাণ করে দেখাতে হয়।
৬ থেকে ১২ মাসের কোর্স
স্নাতক শেষে মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি কোর্স করা যায়। ভর্তির সুযোগ সাধারণত বছরে দুইবার (ডিসেম্বর/জানুয়ারি ও জুন/জুলাই)। কোর্স শেষে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি করারও সুযোগ আছে।
১ বছরের ডিপ্লোমা ইন অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং কোর্সের খরচ প্রতিষ্ঠানভেদে ৪৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। আর ৬ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স ইন অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিংয়ের খরচ পড়বে ২৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। সবচেয়ে ভালো হয় ‘এমবিএ ইন প্রডাক্ট অ্যান্ড ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিং’ (১-২ বছরের কোর্স, খরচ দেড় থেকে তিন লাখ টাকা) করতে পারলে। ভর্তির সময় নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে বাকিটা মাসে মাসে কিস্তিতে দেওয়া যাবে। কোর্সে ওভেন, নিট ও সোয়েটারের ওপর থিওরিটিক্যাল ক্লাসের পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসও নেওয়া হবে।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কোর্সের সঙ্গে স্পোকেন ইংলিশ ও কম্পিউটার কোর্স অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল (বুটেক্স), বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি),
শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিসহ (এসএমইউসিটি), ম্যার্চেন্ডাইজারস ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি (এমআইএফটি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন টেকনোলজি (বিআইএফডিটি)-সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে মার্চেন্ডাইজিং কোর্স চালু আছে।
সুযোগ সুবিধা
একেবারে নতুন বা অনভিজ্ঞ প্রার্থীকে অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সাধারণত মার্চেন্ডাইজার, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার ও মার্চেন্ডাইজার ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। ইয়র্ক গ্রুপের মার্চেন্ডাইজ ম্যানেজার গাজী সালাউদ্দিন হিমেল জানান, শুরুতেই একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজারের বেতন সাধারণত ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধরা হয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতা-অভিজ্ঞতাভেদে সিনিয়রদের বেতন লাখেরও বেশি হতে পারে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের গাড়ি-বাড়িসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায়, একজন মার্চেন্ডাইজার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই বায়িং হাউস কিংবা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুলে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন।
মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজের সুযোগ কেমন, বায়িং হাউসের কাজের ধরন, নিয়োগে কী কী দেখা হয়, পদোন্নতি কিভাবে?
মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজের সুযোগ কেমন?
—বিশ্বের অনেক নামকরা পোশাক প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ড তাদের প্রডাকশনের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব আঞ্চলিক বা লিয়াজোঁ অফিসের পাশাপাশি ট্রেডিং হাউসের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশি-বিদেশি সব মিলিয়ে দেশে বায়িং হাউসের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। আর বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। এ ছাড়া টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান, কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান ও ফ্যাশন ডিজাইন হাউস তো আছেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মার্চেন্ডাইজারের দরকার হয়।
বায়িং হাউসের কাজের ধরন?
—বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বায়িং হাউসগুলোতে সাধারণত দুই ধরনের কাজ হয়। ১. লিয়াজোঁ অফিস হিসেবে সরাসরি বায়ারের পক্ষে কাজের তদারকি করে, অথবা ২. ট্রেডিং হাউস হিসেবে এক বা একাধিক বায়ারের কাছ থেকে সরাসরি অর্ডার নিয়ে উপযুক্ত কারখানা থেকে তা প্রডাকশন করে। চাহিদা অনুসারে উভয়ই ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে প্রাইজ নেগোসিয়েশন, অর্ডার ফলোআপ, শিপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট, পেমেন্ট ফলোআপ, কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কাজ করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো বায়ারের জন্য উপযুক্ত কারখানা খুঁজে বের করা।
কাজের দক্ষতার পাশাপাশি একজন মার্চেন্ডাইজারের আর কী কী গুণ থাকা উচিত?
—তাই সময়জ্ঞান আর কাজের গুরুত্ব অনুধাবন এই পেশার জন্য জরুরি। তবে অন্যতম গুণ বা যোগ্যতা হলো ইংরেজিতে পারদর্শিতা।
বিবিএ-এমবিএ অথবা অন্য যেকোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রার্থীরা কি মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে?
—অবশ্যই সম্ভব। বিবিএ-এমবিএ ডিগ্রিধারীদের বায়িং হাউসের বিভিন্ন বিভাগে কাজের সুযোগ আছে। যেকোনো বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রার্থী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পাবেন।
চাকরিপ্রার্থীদের বয়সের ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি না?
—চাকরির ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তবে এন্ট্রি লেভেলে তরুণদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
মার্চেন্ডাইজার হিসেবে নারীদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ কেমন?
—বর্তমানে নারীরাও এ পেশায় ভালো করছে। এমনকি বেশ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।
প্রার্থী বাছাইয়ে সময় কী কী দেখা হয়?
—এন্ট্রি লেভেলে স্মার্টনেস ও ইংরেজিতে যোগাযোগের দক্ষতাই প্রথমে দেখা হয়।
এ ছাড়া কম্পিউটারে কাজের পারদর্শিতার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতা কেমন—সেটাও দেখা হয়।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বিবেচনা করা হয়?
—নেতৃত্বগুণ, ইংরেজিতে যোগাযোগের দক্ষতা, কাজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি পদোন্নতির ক্ষেত্রে দেখা হয়। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে মার্চেন্ডাইজার, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার, মার্চেন্ডাইজার ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান।
Parvez Mosharof
First year
Bangabandhu textile engineering College
Comments
Post a Comment