Skip to main content

সাইনফা (পর্বঃ ০১)

নুপুর পায়ে হেটে যাওয়ার মৃদু আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল সামিরের। ঘুম জড়ানো চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। সারাদিন জার্নি করে এসে নিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে সামির। একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাসাতে যেতে হয়েছিল তাকে। লম্বা জার্নির পরের ঘুম কিছুটা গাঢ় হয়। যদিও এই বাসায় আসার পর থেকে সামান্য আওয়াজেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। এমনকি একটা মশার শব্দেও। কিন্তু আজ ক্লান্ত শরীরে রাজ্যের অলসতা চেপে বসেছে। নুপুরের আওয়াজটাও এতক্ষণে পাশে এসে থেমে গেছে। আধো ঘুমের মধ্যেই অনুভব করল, বিছানার উপর ওর পাশে এসে কেউ বসেছে। খুবই পরিচিত মেয়েলী পারফিউমের সুবাস নাকে এসে ঠেকল। হাসনাহেনা ফুলের সুবাসিত পারফিউমটার নেশাকর সুগন্ধি মানেই নিশ্চত আশেপাশে সাইনফা রয়েছে। সাইনফা নামের মেয়েটাই এই বাংলোতে সামিরের একমাত্র সঙ্গী। 

শহর থেকে অনেকটা দূরে প্রকৃতিকন্যার মতো বিলাশবহুল বাংলোটাতে কেবল ওদের দুজনেরই বসবাস। বাংলোর আশেপাশে আর কোন জনবসতি নেই, অর্থাৎ কোন প্রতিবেশীও নেই।
"সাইনফা" নামটা শুনতে কিছুটা উদ্ভব লাগে। এটা আবার কেমন নাম? প্রশ্নটা মাঝেমধ্যেই সামিরের মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু কখনও জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি। নামটা উদ্ভব হলেও মেয়েটা অসম্ভব রকমের সুন্দরী। আগ্নেয়গিরির মতো টকটকে রক্তিম আর মসৃণ তার দেহখানি। হরিণী চোখজোড়া এতটাই নেশাকর যে, হারিয়ে যাবার ভয়ে ওচোখে তাকানোটা খুবই দুঃসাহসিক ব্যাপার। নদীর স্রোতের মতো ঘন কালো সিল্কি চুল থেকে ছড়ানো সুবাসকে মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পারফিউম। এমন কল্পনাতীত অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ধরিত্রীকূলে বেমানান। ওর স্থান হওয়া উচিত ছিল রূপকথার রাজ্যের কোন পরীস্থানে। সাইনফার রূপ-লাবণ্যের কাছে পরীরাও হার মেনে যাবে।

পর্দার ফাক দিয়ে চাঁদের আলো এসে মুখের উপর পড়াতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল সামিরের। ওর "নাইট স্ট্রাক" নামক এক ধরনণের অসুখ আছে। এই রোগে আক্রান্তরা চাঁদের আলো থাকলে ঘুমাতে পারে না। সাইনফা উঠে গিয়ে পর্দাটা ভাল করে টেনে দিল। এতক্ষণে চোখ মেলে তাকিয়েছে সামির। গাঢ় অন্ধকার রুমের মধ্যেও সাইনফার অবয়ব স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। মুখখানি সম্পূর্ণ দেখা না গেলেও নারীসৌন্দর্যের নেশা সামিরকে ঠিকই গ্রাস করে নিল। শোয়া থেকে উঠে খাটে হেলান দিয়ে আধোশোয়া হয়ে বসল ও।
সামিরকে উঠে বসতে দেখে সাইনফা পাশে এসে বসলো। আলতোভাবে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
  - উঠে পড়লে যে, আর ঘুমাবে না?
সাইনফার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামির উল্টো প্রশ্ন করল,
  - তুমি এতক্ষণে আসলে? কোথায় ছিলে?
সামিরের কন্ঠে অভিমানের আবির্ভাব বুঝতে পেরে সাইনফা জবাব দিল,
  - আমি তো সারাক্ষণ বাংলোতেই ছিলাম।
  - আমি ফিরে এসে তো তোমাকে কোথাও দেখলাম না। বাংলোর আশেপাশে সবজায়গায় খুঁজেছি।
  - সব খুঁজেছ, কিন্তু একটা জায়গা বাদে। যেটা আমাদের দুজনের জন্য খুবই বিশেষ একটা জায়গা। আমি সেখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
সাইনফার কথায় সামিরের বুদ্ধির বাতি জ্বলল। মনে পড়ে গেল, ওদের সবথেকে বিশেষ স্থানটার কথা। দুজনের সবথেকে বেশি সময় কাটে সেখানে। জায়গাটা দূরে কোথাও না, বাংলোর ছাদেই। সামির যখন কোন কাজে বাংলোর বাইরে যায়, তখন সাইনফা একা একা ছাদে বসে ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকে। আজকেও সেটাই করেছে সাইফা। কিন্তু সামিরের একটুও মনে ছিল না বিষয়টা।

অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে সামিরের। একটা মেয়ে সারারাত ধরে ছাদে বসে বসে ওর ফেরার অপেক্ষা করছে আর ও সেটা ভুলে বসে আছে। এটা মস্ত বড় ভুলই বটে। সামির তাৎক্ষণিক সাইনফার হাত দুখানা দুহাতে জড়িয়ে নিল। তারপর ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল,
  - আমার একটুও মনে ছিল না, তুমি যে ছাদে বসেছিলে। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এরকমটা আর কোনদিন হবে না। এবারের মতো ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?
হাতজোড়া ঠোটের কাছে নিয়ে আলতো চুম্বন করে সাইনফা বলল,
  - এতে ক্ষমা চাইবার মতো কিচ্ছু হয়নি। তুমি তো আর ইচ্ছে করে ভুলে যাওনি।
  - তবুও..আমার উচিত ছিল..
সামিরের কথা শেষ হবার আগেই ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে দিল সাইনফা। মায়াজড়ানো কন্ঠে বলল,
  - যেটা হবার হয়ে গেছে, ওসব ভেবে কোন ফয়দা নেই। এখন তোমার ঘুমানো উচিত।
  - এখন আর ঘুম আসবে না।
  - তুমি শুয়ে পড়, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
বাধ্য ছেলের মতো বালিশে মাথা রেখে সামির বলল,
  - বললাম তো ঘুম হবে না। তুমি ঘুমাবে না?
  - হুম, আমিও ঘুমাব।
সামির শুয়ে পড়ার পর সাইনফাও ওর দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ফুলের মতো নরম হাতে সামিরের কপাল হাত বুলাতে লাগলো। বাংলোর বাইরে দূরে কিছু রাতজাগা প্রাণীর আওয়াজ ভেসে আসছে। সামিরের একবার মনে হল, এখন দুজনে কিছুক্ষণ বাহির বারান্দায় বসে গল্প করতে। কিন্তু সেটা বলার সময়টুকু সে আর পেল না, তার আগেই ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাল সামির। সাইনফার ডাকে যখন ওর ঘুম ভাঙল, সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সামির। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জালানার পর্দাগুলো টেনে দিল। সূর্যের তীর্যক আলোর ঝলক পুরো ঘরটাকে আলোকিত করে তুলল। পেটের উপর হাত রেখে আকাশমুখী হয়ে ঘুমিয়ে আছে সাইনফা। ওকে ডেকে তুলে দিয়ে নিজে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ডাকতে গিয়েও চুপ করে গেল সামির। সূর্যের আলোতে সাইনফার ফর্সা বদনখানি ঝলমল করছে। ও সবসময় চুলগুলো খোলা রাখে। গরমের দিন, তাই রুমে বৈদ্যুতিক পাখা চলছিল। পাখার বাতাসে কয়েকটা চুল বারবার মুখের উপরে এসে পড়ছিল। কাছে গিয়ে সামির অতি সন্তর্পণে চুলগুলো কানের পেছন দিকটায় গুজে দিল। আপন মনে অনেকক্ষণ পাশে বসে থেকে মন ভরে দেখল ঘুমন্ত সাইনফাকে। এত সুন্দরী, এত লাবণ্যময়ী রমণী সামির সামির কখনই দেখেনি। ওকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করত না, এত রূপবতী মেয়ে এই পৃথিবীতে আছে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সামিরের ঘোর কাটে। দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল ও। লম্বা-কালো কোট গায়ে জড়িয়ে অর্ধবয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ে সদ্য কালি করা চলচকে কালো সু, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে তাকান, যার জন্যে কিছুটা ট্যারা মনে হচ্ছে। হাতে কিছু কোর্ট ফাইল অতি যত্নে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। সামিরকে দেখেই মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
  - হ্যালো স্যার...কেমন আছেন?
লোকটাকে সামির চিনতে পারেনি। তবে উনি একজন উকিল এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অগত্যা সামির উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
  - জ্বি ভাল আছি। আপনার পরিচয়?
  - আমার নাম অ্যাডভোকেট অরিন্দর চ্যাটার্জী। রামকান্ত বাবু  আমাকে পাঠিয়েছেন।
  - ওহ আচ্ছা, বাংলোর সামনের ঐ জমিটার ব্যাপারে তো?
  - জ্বি।
  - আসুন..ভেতরে আসুন।
অ্যাডভোকেট অরিন্দর চ্যাটার্জী সামিরকে অনুসরণ করে ভেতরে গিয়ে বসলেন। বাংলোটার বেশ প্রশংসা করলেন উনি। সামির জিজ্ঞেস করলেন,
  - অরিন্দর বাবু, কি নিবেন? চা না কফি?
  - না না, কিছু লাগবে না।
  - সেটা বললে কি আর হবে? আপনি আমার বাংলোয় এসেছেন, মেহমান। একেবারে খালিমুখে কি কথা বলা যায়?
একটু লাজুক ভঙ্গিতে অরিন্দর বাবু আমতাআমতা করতে লাগলেন। সামির বলল,
  - আপনি দেখি লজ্জা পাচ্ছেন! আচ্ছা কফি চলবে তো?
অরিন্দর বাবু এবার আগের থেকে বেশি লজ্জা পেয়ে গেলেন। হ্যাবোধক মাথা নেড়ে কফির প্রস্তাবকে সমর্থন দিলেন। সামির উঠে কিচেন রুমের দিকে গেল কফি বানিয়ে আনতে।

মিনিট কয়েক পরে সামির কিচেন থেকে বেড়িয়ে এলো। হাতে দুকাপ গরম কফি, অরিন্দর বাবুকে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নিল। কফিতে চুমুক দিয়ে অরিন্দর বাবু বললেন,
  - আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না! আপনি একাই থাকেন এখানে?
  - না না! একা না, আমার স্ত্রী থাকে আমার সাথে। ওর শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল, তাই ঘুমাচ্ছে।
  - ওহ আচ্ছা..।
বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন অরিন্দর বাবু। তাড়াতাড়ি কয়েকটা চুমুক দিয়ে কফিটা শেষ করে উনি বললেন,
  - স্যার, যেকাজের জন্য আসা, সেটা সেরে ফেলি?
  - হ্যা নিশ্চয়ই। তবে স্যার ডাকাটা মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমার নামটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।
একটু অপ্রস্তুতভাবে অরিন্দর বাবু জবাব দিলেন,
  - একদম অজানা না, মি. সামির।
একগাল হেসে দিয়ে সামির বলল,
  - আমি রামকান্ত বাবুকে বলেছিলাম জমিটার রেজিস্টারের ব্যাপারে সব কাগজপত্র প্রস্তুত করে ফেলতে, সেটার কতদূর কি হল?
  - উনার কথামতো আমি খসড়া তৈরি করে এনেছি। এখন আপনি যেদিন সময় করে রেজিস্টার অফিসে যাবেন, সেদিনই চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি হবে। এইযে খসড়া কাগজপত্র, আপনি একটু দেখে নিন।
এই বলে অরিন্দির বাবু উনার হাতে থাকা কোর্ট ফাইল থেকে একগাদা কাগজ বের করে সামিরের দিকে এগিয়ে দিলেন। সামির হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিজের কাছে নিয়ে নিল। মনোযোগ সহকারে খসড়া কাগজপত্র সবগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে রাখল। যতদূর বুঝতে পারল, সব ঠিকঠাকই আছে। অরিন্দর বাবু জিজ্ঞেস করলেন,
  - সব ঠিক আছে তো?
  - হুম..ঠিকই তো মনে হচ্ছে।
  - তাহলে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি কবে করছেন?
একটু ভেবে নিয়ে সামির বলল,
  - উমম..পুরো টাকাটা দিয়েই তো রেজিস্ট্রিটা হবে। ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলতে হবে। আজকে তো বৃহস্পতিবার, আগামী দুইদিন ব্যাংক বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ রবিবারের আগে টাকা তোলা সম্ভব না। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী সোমবার নাগাদ রেজিস্ট্রির কাজটা করা যাবে।
  - আগামী সোমবার?
  - হুম..কোন সমস্যা?
  - না না, কোন সমস্যা নেই। তাহলে আপনি টাকাটা উত্তোলন করে আমাকে জানিয়ে দিবেন। আমি সেই অনুযায়ীই সব ঠিক করে রাখব।
  - আচ্ছা ঠিক আছে।
  - তাহলে আজ উঠি?
  - দুপুরের খাবার টা আমাদের সাথে খেয়ে গেলে খুশি হব।
  - আজকে ক্ষমা করবেন, আমার স্ত্রী আজ শখ করে আমার পছন্দের বনমোরগ ঝোল করেছে। সময়মত বাসায় হাজির না হলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।
  - ওহ তাহলে আর কি করা, অন্য একদিন হবে।
  - জ্বি অবশ্যই।
অরিন্দর বাবু হাসিমুখে সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সামিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাংলো থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

দুপুর গড়িয়ে এসেছে অথচ এখন পর্যন্ত সকালের নাস্তা পর্যন্ত পেটে পড়েনি। রান্নাবান্নার কাজটা কদিন যাবৎ সামির নিজেই করছে। একজন কাজের মহিলা ছিল, দুবেলা এসে রান্নাবান্না আর ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। তার বাড়ি এখান থেকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে। আসতে যেতে সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে গতমাসে বিদায় নিয়েছে। তারপর থেকে সবকাজ সামির নিজেই করে। এতে অবশ্য ওর খুব একটা অসুবিধে হয় না। বিলেতে পড়াশুনার সময় থেকেই এসব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে বিদেশে পড়াশুনার সুযোগ হয়েছিল সামিরের। শুধু তাই না, অসম্ভব রকমের মেধাও ছিল ওর। লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পড়াশুনা পর্ব সমাপ্ত করে। অতঃপর মেধার জোরে চাকরি জুটে যায় নাসার মতো বিখ্যাত স্পেস গবেষণা কেন্দ্রে। ওখানে টানা পাঁচটা বছর গবেষণার মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। গবেষণার জন্য মহাকাশ পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছে সে। অনেকগুলো সফলতার সাথে সাথে অর্জন করেছে বিপুল অর্থসম্পত্তিও। কিন্তু সেই সাথে এই পাচ বছরে তাকে হারাতে হয়েছে তার সব থেকে বড় সম্পত্তি।
সেই দিনটার কথা ওর এখনও স্পষ্ট মনে আছে। গবেষণার কাজে টিমের সাথে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিল সামির। ও এর আগেও বেশ কয়েকবারই এসব অভিযাত্রায় গিয়েছে। কিন্তু সেইবারের যাত্রাটাকে কেন জানি অন্যরকম মনে হচ্ছিল। দূর মহাকাশ থেকে পৃথিবীটাকে দেখে বারবার সেখানে ছুটে যেতে মন চাচ্ছিল ওর। কিন্তু এসব গবেষণাকাজে আবেগের কোন স্থান নেই। অনেক বড় গুরুদায়িত্ব নিয়ে সারা পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছে তারা, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। অগত্যা মনের মধ্যে পাথরচাপা দিয়ে গবেষণায় মনোযোগ দিতে হয়েছে। পুরো গবেষণাতে কয়েকটা মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে তারা সফলতা নিয়েই তারা পৃথিবীতে অবতরণ করে। বিশ্ব ওদের কাজে বাহবা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই সফলতার আনন্দে মেতে উঠলেও সামিরকে থমকে যেতে হয়েছিল সেদিন।
পৃথিবীতে অবতরণের পরপরই সামিরকে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। গত দেড়মাস আগে ওর বাবা-মা দুজনেই সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা জেনে বিষয়টা এতদিন ধরে নাসা কর্তৃপক্ষ সামিরকে জানায়নি। সেজন্য তারা ওর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক সনবেদনা জানায়। কিন্তু সামির কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারেনি।

সব ফেলে দেশে ফিরে আসে সামির। কিন্তু হায়! বাবা-মায়ের মুখখানি শেষবারের মতো দেখার সুযোগটুকুও জোটেনি কপালে। একমাত্র ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আত্মীয়স্বজনের তত্ত্বাবধানে দাফনকাজ সেরে ফেলা হয়েছিল। সেদিন বাবা-মায়ের কবরের পাশে বসে অনেক কেঁদেছিল ও। পৃথিবীর বুকে তার আপনজন বলতে ছিল শুধু  বাবা-মা। তাদের মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত দেড় মাস পড়ে শুনতে হয়েছে তার কাজের জন্য। বিষণ্ণতা পুরোপুরিভাবে গ্রাস করে নেয় ওকে। সবকিছুর জন্য নিজের পেশার উপর দোষ চাপাতে থাকে। একটা সময় নাসার সাথে কাজের চুক্তি থেকে ছুটে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু চুক্তিনামা অনুযায়ী সামির চাইলেই সেটা ছেড়ে দিতে পারবে না। বড়জোর লম্বা সময়ের জন্য ছুটি নিতে পারবে। অতঃপর ছয়মাসের ছুটিতেই দেশে থেকে যায় সামির।
ঢাকা শহরের কোলাহোলের মাঝে একাকী জীবনটা খুবই বিষণভাবে কাটছিল ওর। সারাক্ষণ একা একা বসে থেকেই সময় কেটে যেত। ওকে ওরকম মনমরা দেখে বন্ধুবান্ধব পরিকল্পনা করে ওর বাসার ছাদে একটা পার্টির আয়োজন করে। সেই রাতের পার্টির পর থেকেই আবার ওর জীবিনের মোড় ঘুরে যায়। চেনা বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে একটা অচেনা মুখ সামিরের নজর কাড়ে। অল্প আলোর মাঝে সেই মুখখানি মুক্তোর মতো ঝলঝল করছিল। নিজের অজান্তেই সামির অচেনা মুখের সেই মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দেয় ও। মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে সামিরের সাথে হাত মিলিয়ে কোকিল কন্ঠে নিজের নাম উচ্চারণ করে, "সাইনফা"।

সেই রাতের পার্টির পর থেকে সাইনফার সাথে ওর নিয়মিত দেখা হতে থাকে। দুজনের সম্পর্কটা ধীরেধীরে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। শহরের ইটপাথরে জীবনটা থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল দুজনেই। অতঃপর কোনভাবে এই বাংলোটার খোজ পায় ওরা। বাংলোর মালিক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে সেখানে চলে যাবে। তাই সে বাংলোটা বেচে দিতে চাচ্ছে। দেখে পছন্দ হওয়াতে নগদ টাকায় বাংলোটা কিনে নেয় সামির। বাবার অর্জিত অর্থসম্পদ আর শহরের বাড়িটা দেখাশুনার জন্য দূরসম্পর্কের এক কাকার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সাইনফাকে নিয়ে এই বাংলোয় এসে উঠে। তারপর থেকে ওরা দুজনে এখানেই থাকে।
সামিরের ছুটির এখনও মাস দুই বাকি আছে। তারপর ওকে আবার আমেরিকা ফিরে যেতে হবে। তবে সামির ঠিক করেছে, এবার সে আর একা যাবে না। সাইনফাকে সাথে নিয়ে যাবে। এরমধ্যে বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলবে বলে ঠিক করে রেখেছে। তবে মূল কাজটা এখনও বাকি রয়ে গেছে। সামির এখনও সাইনফাকে বিয়ের কথাটাই তো বলেনি!
(পাঠক অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন, বিয়ে ছাড়াই এরা একসাথে থাকছে। আগেই এসব ভাববেন না। গল্প তো, দেখাই যাক না কাহিনী কোনদিকে গড়ায় 😉)


চলবে...


© মোঃ শামীম শিহাব

★ এই গল্পের সকল চরিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই। যদি এর কোন অংশ কারও ব্যক্তিজীবনের সাথে মিলে যায়, সেক্ষেত্রে লেখক কোনরূপ দায়ী নয়।

Comments

Popular Posts

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়া ও তাসবীহ সমূহ

জায়নামাযে দাঁড়ানোর দোয়া اِنِّىْ وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِىْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ حَنِيْفًا وَّمَا اٰنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- উচ্চারণ-ইন্নি ওয়াজ্জা...

টেক্সটাইল ডাইং কেমিক্যাল গুলির নাম এবং ব্যবহার

ডাইং ফিনিশিং এ ব্যবহৃত কেমিক্যালগুলোর নাম এবং ব্যবহার জেনে নিন : ১. সোডা  :  কালার ফিক্সং  করে কোভেলেন্ট বন্ড তৈরি করে। তাছাড়া PH কন্ট্রোল , ফেব্রিকের এবজরবেন্সি বাড়ানোর জ...

Countries in the World

This website uses cookies to ensure you get the best experience on our website. Learn more Got it! Countries in the World: 195 # Country Population (2020) Land Area (Km²) 1 China 1,439,323,776 9,388,211 2 India 1,380,004,385 2,973,190 3 United States 331,002,651 9,147,420 4 Indonesia 273,523,615 1,811,570 5 Pakistan 220,892,340 770,880 6 Brazil 212,559,417 8,358,140 7 Nigeria 206,139,589 910,770 8 Bangladesh 164,689,383 130,170 9 Russia 145,934,462 16,376,870 10 Mexico 128,932,753 1,943,950 11 Japan 126,476,461 364,555 12 Ethiopia ...