Skip to main content

এক দিনের রাজা

আজ ঈদুল ফিতরের দিন।

সাধারণত সব ঈদেই আমি বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু প্রসংগত এই ঈদে যেতে পারিনি। এজন্য যতটা না মন খারাপ, তার চেয়ে বেশিই বিরক্ত হচ্ছিলাম বাড়ি থেকে বারবার ফোন করার জন্য। লাগাটাই স্বাভাবিক। অন্য সবার মতো আমারও তো বাড়িতে ঈদ পালানের ইচ্ছা হয়। কিন্তু বিশেষ সমস্যার কারণে যেতে পারিনি। এখন যদি এভাবে বারবার ফোন করে তাহলে তো সেটাই মনে হয়ে যায়।

ঈদের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই গোসল করে হালকা সেমাই নাস্তা করে নিলাম। রান্না করার কেউ নেই আজ, তাই এর থেকে বেশিকিছু কপালে জুটবারও কথা না। ঈদের নামাজ শেষ করে বাসায় আসলাম। সারা বাসায় মনে হয় এক দারোয়ান আর আমিই আছি। বাকি সবাই যার যার ফ্যামিলি নিয়ে ঈদ পালন করতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। আমারও ছোট একটা সংসার থাকার কথা, যেটা এই বাসার সবাই জানে। কিন্তু আসলে নেই। সেটা ছিল ব্যাচেলার ভাড়া না দেওয়ার ফ্যাক্ট।
ঘটনা হল যখন বাসা ভাড়া খুঁজতে এসেছিলাম, তখন আমার বস সাথে ছিল। এই বাসাটা খুব পছন্দ হয় আমাদের। বাড়িওয়ালা যখন বলছিল, ব্যাচেলার ভাড়া দেওয়া হবে না। ঠিক তখনই হুট করে বস বলে দিল আমি নাকি ম্যারিড! ব্যস, তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল "ম্যারিড লাইফ ইউথআউট অ্যা ওয়াইফ!"

বাসায় ফিরে একা একা খুব বোরিং লাগছিল। জীবনের বেশিই ভাগ সময়ই আমি একাই থেকেছি, কখনো এত খারাপ লাগেনি। হঠাৎ কি ভেবে মনে হল, আজ রাস্তায় ঈদ করব।
বেশ অনেকদিন হল ঢাকায় আছি, কত ধরনের মানুষ দেখিছি সেটার হিসাব নিশ্চয়ই থাকার কথা না। এর মধ্যে অনেক লোককে দেখেছি, তাদের জীবনের সবই হল রাস্তায়। তারা কাজ করে রাস্তায়, খায় রাস্তায়, এমনকি তারা রাতে থাকেও এই রাস্তাতেই। হয়তো কেউ কেউ আবার পাশের বস্তিতেও থাকে। আমার জানা নেই। কারণ, আমিও আপনাদেরই মতো নিজের প্রয়োজনে ভদ্রলোক! এদের মতো রাস্তার কীটের খবর জানার ইচ্ছা কখনো জাগেনি আমার। কখনও ইচ্ছে হয়নি তাদের কষ্টটা জানার!

যেহেতু আমি একা আচ্ছি, সেক্ষেত্রে ঈদের দিনে বিশেষ কোন প্ল্যান নেই। একটা গার্লফ্রেন্ড আছে, সেও ঈদে তার দাদার বাড়িতে চলে গেছে। তাই সময় নিয়েই কোন চিন্তা নেই। বেড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়।

সকাল ১১ টার মতো বাজে তখন। আমি হেটে চলছি। উদ্দেশ্য কিছু সংখ্যক রাস্তার মানুষ খুজে বের করা এবং তাদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেওয়া।
রাস্তায় কিছু ছোট ছেলেপেলে খেলছিল। সবার বয়সই ৭-১০বছরের মতোই হবে। আমি তাদের কাছে এগিয়ে গেলাম। তাদের ব্যাপারে কিছু জানার জন্য বললাম, "এই বাচ্চারা কি খবর তোমাদের?"
আমার কথা শুনে তারা সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখলো। তারপর কিছু না বলেই সবাই সেখান থেকে সরে গেল। আমি আরো কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই ছেলেগুলো কেটে পড়ে।
ব্যর্থ হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। এবারও আগের মতোই আরেক দলকে পেলাম। তারাও আমার কথা শুনার আগেই চলে গেল। চলে যাবার কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। এবার তৃতীয় চেষ্টা। এবার একটা সাত/আট বছরের ছেলে রাস্তা থেকে কিছু একটা কুড়াচ্ছিল। উৎসুক হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার আমার-আপনার মত ভদ্রলোকের স্টাইলে ডাকলাম। যে ডাকে কোন সহানুভূতির ছিটেফোঁটাও নেই।
  - অই পিচ্ছি! এদিকে আয়।
এবার ছেলেটি আমার কাছে ছুটে আসলো। বুঝতে পারলাম আগের ছেলেপেলেগুলো কেন আমার ডাক শুনে চলে গেছিলো।
আসলে আমরা বা আমাদের মতো ভদ্রলোকেরা তাদেরকে এমন সমাজের জীব বানিয়েছি, যেখানে তাদের কোন সমাদর নেই। তাদেরকে আমরা নিতান্তই নিচু শ্রেণীর মানুষ মনে করি। তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের সেই স্বাভাবিক ব্যবহার দেখতে দেখতে। আর তাই হয়তো আমার আগের ব্যবহারটা অস্বাভাবিক ছিল। যেখানে ভালবাসা নিয়ে তাদের ডেকেছিলাম।

যাই হোক ছেলেটা আমার কাছে এসে বলল,
  - কি কইবেন কন।
  - কি নাম তোর?
  - নাম জাইনা কি করবেন? কিল্লাই ডাকছেন হেইডা আগে কন।
  - আমার একটা কাজ করে দিতে হবে, পারবি?
  - টেহা দিলে পারমু।
  - হ্যা টাকা দিব।
  - তাইলে তোর নাম বলতে হবে। নাকি এর জন্যও আলাদা টাকা দিতে হবে?
  - আমার নাম সুমন।
  - বাসা কোথায় তোর?
  - ওই পাশের বস্তিতে।
  - আচ্ছা আমাকে নিয়ে চল ওখানে।
  - আপ্নে না কইলেন কি কাম দিবেন?
  - ওখানেই তো আমার কাজ। আগে নিয়ে চল।
আমার কথায় ছেলেটা ভরসা পাচ্ছিল না। আমি একটা একশত টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিলাম। বললাম,
  - বাকিটা কাজের পরে পাবি।
  - আইচ্ছা ঠিকাছে চলেন।
বলেই ছেলেটা বস্তির দিকে হাটা দিল। আমিও তার পেছন পেছন যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
  - বাসায় তোর কে কে আছে?
  - খালি আম্মা আছে। আর কেউ নাই।
  - বাবা নাই?
  - আছে তয় আমাগো লগে থাহে না। আরেকডা বিয়া করছে।
  - তোর আম্মা কি করে?
  - মাইনশের বাসায় কাজ করে।
  - তুই স্কুলে যাস?
  - হ যাই।
জিজ্ঞেস করতে যাব ঈদে কি কি কিনছস, কিন্তু তখন আমার ভেতর মানবতা কাজ করল। যদি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে যাই। তাই আর জিজ্ঞেস করলাম না।
একটা ছোট ঘরের দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে বলল,
  - স্যার এইডা আমাগো ঘর।
  - আচ্ছা আগে তোদের ঘরেই নিয়ে চল।
একটু ইতস্ততভাবে সুমন বলল,
  - আইচ্ছা চলেন।
ঘরের সামনে সুমন তার আম্মাকে ডাকল। একটা অর্ধবয়সী মহিলা ছুটে আসলো।
  - সুমন! বাবা তুই আইছস!
আমি বেশ অবাকই হলাম। এভাবে ছুটে আসার কারণ কি! মনে হল একযুগ পরে মা তার ছেলেকে দেখছে। কিন্তু এই ছেলেও বয়সই তো একযুগ হবে না।
জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ঈদের দিন গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল সুমন। লোকের বাসায় কাজ করে তার মা। সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থাই ঠিকমতো হয় না। গরুর মাংস কিভাবে কিনবে? কিনতে পারেনি। সকালে খেতে বসে গরুর মাংস না পেয়ে রাগ করে খাবার রেখে চলে গিয়েছিল।

আমি কিছুক্ষণের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম। ঘোর কাটিয়ে সুমনকে নিয়ে গেলাম বাজারে। ৩ কেজি গরুর মাংস, ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব বাজার করে ফিরলাম বস্তিতে। সুমনের মাকে বললাম রান্না করতে।
প্রথমে একটি ইতস্ততবোধ করছিল। কিন্তু যখন বললাম, আপত্তি না থাকলে আমিও তাদের সাথেই খাবো। কারণ, আমারও এখনো খাওয়া হয়নি। তখন আর না করতে পারল না। চোখে জল চলে এসেছিল তার। চোখ মুছতে মুছতে রান্না করতে চলে গেল।
সুমনকে বললাম,
  - তোর মহল্লাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারবি?
  - কেন পারুম না! চলেন।
সুমনের সাথে বস্তিতে ঘুরতে ঘুরতে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়েও মিলে গেল। বেশির ভাগই ওর বন্ধু-বান্ধব। সবাইকে নিয়ে ফিরে আসলাম সুমনদের ঘরে। ততক্ষণে রান্না শেষ। সবাই খেতে বসে গেলাম।
একটা বড় পাটিতে সবাই গোল হয়ে একসাথে বসে খাচ্ছি। সুমনের মা খাবার পরিবেশন করছিল। পরম তৃপ্তির সাথে ভোজন পর্ব শেষ করলাম। কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল, আমি একজন রাজা। যে তার রাজ্যের সবাইকে নিয়ে একসাথে ঈদ উৎযাপন করছে।
ভোজনপর্ব শেষ করে সবার সাথে বিদায় নিলাম। আসার সময় সুমনকে এক হাজার টাকা দিলাম। ও নিতে চাইছিল না। বলছিল,
  - আপ্নে তো কইছিলেন কাম কইরা দিলে টেহা দিবেন। কাম তো করি নাই, তাইলে টেহা কিসের?
  - কে বলেছে তুই কাজ করিছ নাই। তুই যেটা করেছিস, সেই কাজের জন্যই আমি তোকে বলেছিলাম।

টাকাটা সুমনের হাতে দিয়ে বেড়িয়ে আসলাম আমার একদিনের রাজ্য থেকে। যেখানে #এক_দিনের_রাজা হয়ে গিয়েছিলাম।

লেখাঃ মোঃ শামীম শিহাব

রাত ০৮:৪৫ মিনিট
জুন ১৬, ২০১৮ইং

Comments

Popular Posts

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়া ও তাসবীহ সমূহ

জায়নামাযে দাঁড়ানোর দোয়া اِنِّىْ وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِىْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ حَنِيْفًا وَّمَا اٰنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- উচ্চারণ-ইন্নি ওয়াজ্জা...

টেক্সটাইল ডাইং কেমিক্যাল গুলির নাম এবং ব্যবহার

ডাইং ফিনিশিং এ ব্যবহৃত কেমিক্যালগুলোর নাম এবং ব্যবহার জেনে নিন : ১. সোডা  :  কালার ফিক্সং  করে কোভেলেন্ট বন্ড তৈরি করে। তাছাড়া PH কন্ট্রোল , ফেব্রিকের এবজরবেন্সি বাড়ানোর জ...

Countries in the World

This website uses cookies to ensure you get the best experience on our website. Learn more Got it! Countries in the World: 195 # Country Population (2020) Land Area (Km²) 1 China 1,439,323,776 9,388,211 2 India 1,380,004,385 2,973,190 3 United States 331,002,651 9,147,420 4 Indonesia 273,523,615 1,811,570 5 Pakistan 220,892,340 770,880 6 Brazil 212,559,417 8,358,140 7 Nigeria 206,139,589 910,770 8 Bangladesh 164,689,383 130,170 9 Russia 145,934,462 16,376,870 10 Mexico 128,932,753 1,943,950 11 Japan 126,476,461 364,555 12 Ethiopia ...