Skip to main content

একজন ইঞ্জিনিয়ারের গল্প

ভাইভা বোর্ডে ৩ জন অফিসার বসে আছে। একটু পরেই ইন্টারভিউ শুরু হবে। দুই বছর প্রচেষ্টার পর এই ভাইভা বোর্ড পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছি। বোর্ডে আমার ডাক পরলো।
-স্যার আসতে পারি?
-হ্যা আসুন।
১ম প্রশ্নকর্তাঃ আপনার নাম কি?
  - আদনান হাসিব।
২য় প্রশ্নকর্তাঃ আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি?
-স্যার, বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং।
২য় জনঃ এই ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কত বছর?
-কোন অভিজ্ঞতা নেই স্যার। আমি নতুন।
(৩ প্রশ্নকর্তা আমাকে আরো অনেক প্রশ্ন করলেন)
৩য় প্রশ্নকর্তাঃ আদনান হাসিব আপনাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু!
-বলেন স্যার!
১ম প্রশ্নকর্তাঃ টেবিল টা একটু গরম করতে হবে।
আপনাকে পছন্দ হয়েছে। তাই আপনি ৪ লাখ
দিলেই হবে। অন্যরা ৭ লাখ দিবে বলেছে।
(আমি পুরাই চমকে গেলাম)
-কিন্তু স্যার আমারতো ফার্স্ট ক্লাস সার্টিফিকেট আছে। আর তাছাড়া আমি এতো টাকা দিতে পারবো না।
২য় প্রশ্নকর্তাঃ (রেগে গিয়ে) রাখেন আপনার কাগজের সার্টিফিকেট। টাকা দিতে পারলে হবে, নয়তো আপনি আসতে পারেন।
মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলাম। কিছু করার নেই আমার। এই টাকা দেয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই।
.
আমি আদনান।
২ বছর হলো বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে
বেড়িয়েছি। তখন থেকেই অফিসে অফিসে
চাকুরীর জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু লাভ হয় নি।
সবাই অভিজ্ঞতা চায়। আমার তো সেটা নেই তাই কোথায় সুযোগ হয় না। আর হয়ে গেলেও অই যে টাকা!
আমি পরিবারের বড় ছেলে। বাবা তার সব কিছু দিয়ে আমাকে বি.এস.সি পাশ করিয়েছে।আর আমি সার্টিফিকেট নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। কাগজেরসার্টিফিকেট গুলো দিয়ে কিছুই হচ্ছে না সবাই চায় টাকা।
ঘরে বাবা অসুস্থ। মাও দিনদিন দুর্বল হয়ে পরছে। ছোট ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ, বোনের বিয়ের বয়সও পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। ছোট ভাই ফোন দিলো এই সময়,
-ভাইয়া বাবার ঔষধ নিয়ে এসো। বাবা অনেক অসুস্থ।
-আচ্ছা।
.
আমি পুরাই থ হয়ে আছি। যে বাবা আমার সকল সাধ পুরণ করেছেন, না চাইতেই সব দিয়েছেন তিনি আজ অসুস্থ্য আর আমি কিছুই করতে পারছি না? দুনিয়ার সবচেয়ে কুলাংগার ছেলে 
মনে হয় আমিই।
হাটতে হাটতে পার্কের দিকে যাচ্ছি। আচমকা অহনার সাথে দেখা।
-আরে আদনান কেমন আছো?
-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
-ভালো। হাতে কিসের ফাইল এটা?
-সার্টিফিকেট।
-অহ! চাকুরীর জন্য গিয়েছিলে মনে হয়?
-হ্যা।
-হয়েছে?
-নাহ, ৪ লাখ টাকা লাগবে বলেছে।
-ওহ।
.
অহনা আমার একমাত্র মেয়ে বন্ধু। বন্ধু থেকে বেশিই। অহনা ধনী বাবার একমাত্র মেয়ে।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, অহনা কেনো যে আমার মতো অপদার্থকে নিজের একমাত্র বন্ধু বানিয়েছে সেটা আমার বোধগম্য নয়।
কিছুক্ষণ ওর সাথে বসলাম। পরে অহনাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে, আসলাম আবিরের অফিসে।
আবির আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসাথে বি.এস.সি পাশ করেছি। আজ সে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অফিসে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে আর আমি চাকুরীর জন্য অফিসে অফিসে ঘুরে পায়ের
জুতা ক্ষয় করি। সবই টাকার খেলা।

পিওন এসে বললো ভিতরে আসুন। আবিরের রুমে গেলাম।
-কিরে দোস্ত, কেমন আছস?
-ভালো।
-কিরে বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?
-চাকুরী টা হলো না।
-আরে চিন্তা করিস না হয়ে যাবে।
-এইদিকে বাবা অসুস্থ। ঔষধ কিনার টাকাও নেই।
-আরে আগে বলবি তো। আমাকে ফোন দিলেই তো পাঠিয়ে দিতাম। এই নে, এইটা রাখ।
-দোস্ত তুই অনেক করেছিস আমার জন্য। আর না।
-চুপ কর। যা চাচার জন্য ঔষধ নিয়ে বাড়ি যা। তোর চাকুরী হলে হিসাব-নিকাশ হবে।(হেসে)
-আচ্ছা।
মুচকি হেসে বেরিয়ে আসলাম অফিস থেকে। সত্যি ওর মতো বন্ধু এখন পাওয়া যায় না। ঔষধ নিয়ে বাড়ি গেলাম।
.
বিকেলে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কি করবো আমি। আমাকে তো কিছু করতেই হবে। আবির কে ফোন দিলাম।
-অফিস শেষে মাঠে আসিস।
-আচ্ছা। আসতেসি।
আবির আর আমি বসে আছি।
-কি করতে পারি আবির?
-চিন্তা করিস না, একটা কিছু হয়ে যাবে।
-আচ্ছা, তোদের অফিসে দেখলাম পিওনের চাকুরীর জন্য লোক নিবে?
-হ্যা।
-আমি আবেদন করবো।
-কি!(চমকে গিয়ে) তোর মাথা ঠিক আছে?বি.এস.সি পাশ করে পিওনের চাকুরী করবি?
-হ্যা। এছাড়া কোনো রাস্তা নেই।
এই কথা বলে চলে আসলাম। আবির অবাক চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
পরের দিন অফিসে গিয়ে আবেদন করলাম।
অফিসের এম.ডি সাহেব আমার শিক্ষাগত
যোগ্যতা দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
আমি না বুঝার ভান করে দাড়িয়ে রইলাম।
জানতে পারলাম চাকুরীটা হয়েছে। তবে এমনি এমনি না!
পিওনের চাকুরীর জন্যও ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে!
টাকা টা আবির ই জোগাড় করেছে।
.
বাড়িতে এসে জানালাম চাকুরী হয়েছে। সবাই আনন্দে আত্নহারা। ছোট বোন বলল,
-ভাইয়া কোন পোস্ট?
আমি হেসে বললাম,
-পিওন!
কথাটা বলা মাত্রই দেখলাম সবাই চুপ। লক্ষ্য করলাম বাবার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। মা নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভাই-বোনেরা যেন আকাশ থেকে পড়লো। চুপি-চুপি নিজের রুমে চলে এসেছি। নিজের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। ভাবছি বি.এস.সি পাশ করে আজ আমি পিওন হয়েছি!
অনেক দিন পর বাবার চোখে পানি দেখলাম।
সারা জীবন কষ্ট করে আমাকে পড়িয়েছেন।বি.এস.সি করা ছেলে সামান্য পিওনের চাকুরী করছে, এই কথা শুনলে পৃথিবীর কোন বাবাই হয়তো ঠিক থাকতে পারতেন না। দুনিয়াটা যে এক আজব জায়গা। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না।
.
যথারীতি অফিসে জয়েন করলাম। আমাকে দেখে আবির কেদেই ফেললো। কিছুই করার নেই আমার। আমি শুধুই একজন পিওন। অফিসের সবার হুকুমের গোলাম আমি, পিওন বলে কথা।
আবির কে দেখি প্রায়ই আমার দিকে তাকিয়ে কাদে।
.
পিওনের চাকুরী দিয়ে কোনোভাবে চলছিলাম।
এর মধ্যে বোনের বিয়ের প্রস্তাব এলো। ছেলে পক্ষ আসলো আমাদের বাড়িতে মেয়ে দেখতে। সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু যখন তারা জানতে পারলো আমি পিওন, তখন তারা পুরোই পাল্টে গেলো।
ছেলের বাবা আমার বাবা কে বললেন,
-আপনার ছেলে একজন সামান্য পিওন। আপনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হতে পরে
না। আপনার মেয়ে আমাদের বাড়ির ঝি হওয়ারও যোগ্য না।
এই বলে তারা চলে গেলো। আমি চুপ-চাপ দাড়িয়ে তাদের কথা শুনলাম। কিন্তু কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। আমার বাবা এতো অপমান কখনই হন নি। আজ আমার জন্য তাকে অপমানিত
হতে হলো। কত বড় অপদার্থ আমি!
বাবার হৃদ রোগের সমস্যা ছিলো। এতো অপমান সহ্য করতে না পেরে বাবা হার্ট-স্ট্রোক করে মারা গেলেন।
আমি সেদিন একটুও কাদি নি। কেনো জানি কান্না আসছিলো না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম বাবার মৃত দেহের দিকে।
বাবার মৃত্যু, বোনের বিয়ে না হওয়া, ভাইয়ের পড়া-শোনা এসব চিন্তায় মাও একদিন আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন।
কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।এতো কিছুর মধ্যে খবর পেলাম অহনার বিয়ে হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি জানলাম না। হয়তো পিওনকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
.
এতো কিছুর মধ্যে বন্ধু আবির আমার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। নিজের খরচে আমার ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছিলো। ভাইয়ের পড়া-শুনার খরচ জোগাতে সাহায্য করেছে।
হয়তো বিধাতা আমার দিকে সু-নজর দিয়েছেন।কিছু দিনের মধ্যেই কোম্পানি তে আরেকজব বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার এর দরকার হলো। আমার যেহেতু সব ছিলো আর এম.ডি স্যারও আমার সম্পর্কে জানতেন। তাই আর সমস্যা হয় নি।
আমি পেয়ে গেলাম চাকুরী। এরপর আর পিছনে ফিরতে হয় নি। কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানীর সকলের আস্থা অর্জন করলাম।হয়ে গেলাম জি.এম।
খুবই অবাক লাগলো আমার। কিছুদিন আগে
ছিলাম পিওন আর এখন জি.এম স্যার।
কিছু দিনের মধ্যেই ছোট ভাইয়ের পড়া-শোনা
শেষ হলো। এখন আমার সব আছে। গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা, মান-সম্মান সব। কিন্তু কিছুই নেই আমার! কারণ যার বাবা-মা নেই, তার যে কিছুই নেই।
কিছুদিন আগে অহনাকে দেখেছিলাম মার্কেটে। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তার স্বামী কে আমি প্রথম দেখেই চিনতে পারি। কারণ, ও হচ্ছে ফয়সাল। আমার ম্যানেজার।
.
পাচ বছর পর, আমি, ছোট ভাই-বোন, বোনের হাজবেন্ড, আবির আমরা সবাই দাড়িয়ে আছি বাবা-মার কবরের সামনে। সবার চোখেই পানি।
আমি চিৎকার দিয়ে বলছি,
-দেখো বাবা, তোমার কষ্ট আজ স্বার্থক হয়েছে।তোমার ছেলে এখন পিওন না বাবা, তোমার ছেলে আজ অফিসার। বাবা দেখো তুমি তোমার মেয়ে আজ কতো সুখে আছে। বাবা তোমার ছোট ছেলে এখন দেশের নামকরা ডাক্তার। তুমি দেখো বাবা!
মাগো, তোমার ছেলে-মেয়েদের আজ সব আছে,
নেই শুধু তুমি মা। মাগো দেখো, আজ আমরা
কতো সুখে আছি। তোমরা একবার একটু দেখো,
মা একবার দেখো।
ছোট বোনের হাজবেন্ড আর আবিরের চোখেও
পানি। তারাও কাদছে। বিধাতা আজ আমাদের সব দিয়েছেন, কিন্তু বাবা-মা নেই। বিধাতার খেলা বুঝার সাধ্য কারো নেই।

© মোঃ শামীম শিহাব

Comments

Popular Posts

নামাযের প্রয়োজনীয় দোয়া ও তাসবীহ সমূহ

জায়নামাযে দাঁড়ানোর দোয়া اِنِّىْ وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِىْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ حَنِيْفًا وَّمَا اٰنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- উচ্চারণ-ইন্নি ওয়াজ্জা...

টেক্সটাইল ডাইং কেমিক্যাল গুলির নাম এবং ব্যবহার

ডাইং ফিনিশিং এ ব্যবহৃত কেমিক্যালগুলোর নাম এবং ব্যবহার জেনে নিন : ১. সোডা  :  কালার ফিক্সং  করে কোভেলেন্ট বন্ড তৈরি করে। তাছাড়া PH কন্ট্রোল , ফেব্রিকের এবজরবেন্সি বাড়ানোর জ...

হুমায়ুন আহমেদ - এর উক্তি সমূহ

১. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে ভালবাসা। ২. ভালোবাসা ও ঘৃনা দুটোই মানুষের চোখে লিখা থাকে। ৩. একজন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে দেখা ও তাকে অসুন্দর হিসেবে আবিষ্কার করার মধ্যবর্তী স...