আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বাড়িটার নাম দেখতে যাই। কিন্তু যেই নামটা লেখাছিলো তা দেখে আমি পুরো আৎকে উঠলাম।
এটা কি করে সম্ভব! এই বাড়িটাতে কখন মিশিরা থাকতো! এই বাড়িতেই কিভাবে এতো রহস্য থাকতে পারে?
আসলে বাড়িটার নাম ছিলো হরিনাথ বাংলো। আমার বাড়ির পাশেই যে বাংলোটা রয়েছে সেটার নামই হরিনাথ বাংলো। এই বাংলোটার কোথাই ডায়েরিটাতে লেখা আছে। আমি অবশ্য এই বাংলোতে কখনও যাইনি। তাই এই বাংলো সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্যও আমার জানা ছিলো না। হয়তো রমিজ চাচা কিছু জানেন। কিন্তু সে তো আর এখন বাড়িতে নেই।
এটা ভেবেই বেশ অবাক হই যে, এই ডায়েরিতে যেই বাড়ির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেটা আমার বাড়ির পাশের সেই হরিনাথ বাংলোটাই! এখানেই কি সেই মিশির পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে? তাহলে এ বিষয়ে এখানকার কেউ কিছু জানে না কেনো!
মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরছিলো। কিন্তু একটা প্রশ্নেরও উত্তর মাথায় আসছিলো না। বুঝলাম যে নিজের মনে এতটা খটকা রাখার কোন মানে হয় না। এই সকল রহস্যের সমাধান পাওয়া যাবে সেই হরিনাথ বাংলোতেই। তাই আমাকে প্রথমে সেই বাংলোতেই যেতে হবে। কিন্তু বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম এখনো সূর্য উঠেনি। তাই ভাবলাম সকাল হলেই বরং সেখানে যাবো। এরমধ্যে হয়তো রমিজ চাচাও চলে আসবে। রমিজ চাচা অনেক পুরানো লোক তাই রমিজ চাচা আসলে সেই হরিনাথ বাংলো সম্পর্কে আরো ভালো করে জানা যাবে। এরপর আমি চুপচাপ শুয়ে পড়লাম সকালের অপেক্ষায়। কখন যে চোখগুলো লেগে গিয়েছিলো বুঝতে পারিনি। এরপর ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায় রমিজ চাচার কন্ঠ শুনে। তখন প্রায় সকাল ১০টা বাজে। রমিজ চাচা হয়তো সকাল সকালই এখানে চলে এসেছে। আমি সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাই না। তাই আমাকে এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে দেখেই রমিজ চাচা আমাকে ডাকলো। আর বললো,
-বাবু !! শরীর খারাপ নাকি যে এতোবেলা পর্যন্ত ঘুমাইতাছেন?!
-আরে রমিজ চাচা! তুমি কখন এলে? আর বলো না। রাতে প্রচুর মাথা ব্যাথা ছিলো তাই ঘুম হয়নি। তাই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি। তোমার খবর কি বলো?
-হুম ভালোই। কিন্তু আপনের কখন থিকা মাথা ব্যাথা? আমি কি চা বানাইয়া নিয়া আসুম বাবু?
- না। থাক তুমি এতদুর থেকে মাত্র এসেছো। গোসল করে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। এরপর না হয় এটা করো।
-কি যে কন না বাবু। এক কাপ চা বানাইতে আর কতক্ষন লাগবো? আপনে একটু বসেন আমি চা নিয়া আইতাছি।
রমিজ চাচা চা বানাতে চলে গেলো। রমিজ চাচার সাথে একটু কথা বলে আমার মনটা অনেক ভালো হয়ে গেলো। গত কয়েকদিনের সব দুঃশ্চিন্তা মাথা থেকে যেনো বেরিয়ে গেলো।
.
একটু পর রমিজ চাচা চা নিয়ে ঘরে আসলো। অনেকদিন পর রমিজ চাচার হাতের চা খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম। রমিজ চাচাকে বললাম,
-চাচা, তোমার হাতের চা না খেলে যেনো আমার দিনই চলে না। তোমাকে ছাড়া যে গত কয়েক দিন কতটা কষ্টে ছিলাম! আর কি বলবো?
-কি যে বলেন বাবু। আপনারে ছাড়া আমিও কি ভালো ছিলাম? শরীরটা ঐখানে ছিলো কিন্তু মনটা সবসময় এই বাড়িতেই পইরা ছিলো।
- হুম ভালোই। আচ্ছা রমিজ চাচা! আমাদের বাড়ির পাশে যে বাংলোটা রয়েছে। মানে হরিনাথ বাংলো। এটা সম্পর্কে কি তুমি কিছু জানো?
-এইটাতো অনেক পুরান একটা বাংলো। কিন্তু হঠাৎ আপনে এইটা সম্পর্কে জানতে চাইতাছেন কেন?
-এমনি জানতে ইচ্ছা হলো চাচা। বাড়িটাতো বেশ বড়। কিন্তু এখানে কেউ থাকে না কেন?
-এইটা আমিও ঠিক কইতে পারলাম না বাবু। তয় কয়েক বছর আগে শুনছিলাম যে এই বাড়িটারে নাকি সবাই ভুতের বাড়ি কইতো। কোন পরিবারই এইখানে আইসা টিকতে পারতো না। সবাই নাকি ভুত দেইখা ভয় পাইয়া চইলা গেছে। শেষমেষ মনে হয় একটা পরিবার আইসা এইখানে উঠছিলো। কিন্তু এর কয়েক মাস পর থিকা নাকি তাদেরো আর খুইজা পাওয়া যায় নাই। এরপরে আর কেউ এই হরিনাথ বাংলোতে থাকে না। এখনো ফাকা পইরা আছে এই বাড়িটা।
-ওহ। আচ্ছা। এমনি জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা চাচা তুমি বিশ্রাম নাও এখন। পরে আবার কথা হবে।
.
রমিজ চাচা ঘর থেকে চলে গেলো। আমি ঘরে একা বসে বসে শুধু হরিনাথ বাংলোর কথা চিন্তা করছিলাম। আমার সাথে যা কিছু ঘটেছে তা আমি কিছুতেই রমিজ চাচাকে বলতে চাচ্ছিলাম না। এমনিতেই সে অনেক আগের যুগের মানুষ। সে যদি এখন এই কথাগুলো শুনে তাহলে শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।
তাই রমিজ চাচাকে আর কিছু বলিনি। এরপর সারাদিন ঘরেই ছিলাম। যদিও সেই ডায়েরি আর হরিনাথ বাংলোর রহস্যটা আমার মাথা থেকে একটুও যায়নি। কিন্তু রমিজ চাচা বাড়িতে আছে এটা ভেবেই বেশ শান্তি লাগছিলো। কিন্তু একবার ভাবলাম কাউকে না বলে একবার হরিনাথ বাংলোতে গিয়েই দেখি যে সেখানে কি আছে? সেখানে কি সকল রহস্যের সমাধান আছে কিনা। কিন্তু মন থেকে সেই সাহসটা পেলাম না। একা একা সেখানে যাওয়া অনেক বিপদজনক। তাই হরিনাথ বাংলোতে যাওয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিলাম। দেখতে দেখতে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেলো। আমি একটু আমার বাড়ির ছাদে গেলাম। বিকালে বেশ বাতাস হয় সেখানে। ছাদে একটা চেয়ারে বসে রইলাম।
একটু পর রমিজ চাচা আমাকে ডাকতে ডাকতে ছাদে আসলো। আমি রমিজ চাচাকে দেখে প্রশ্ন করলাম,
-আরে রমিজ চাচা! ডাকছো কেন?
-আসলে বাবু আমার এখন এক জায়গায় যাইতে হইবো।
-কোথায় যাবে?
-ঐযে পাশের গ্রামে আপনার যেই ধানক্ষেতটা আছে ঐখানে যাইতে হইবো। ঐখানের কৃষক আমারে কল দিছিলো। কইলো যে ধান কাটার সময় মনে হয় হইয়া গেছে। তাই আমার এখন একবার যাওয়া লাগবো। ফিরতে ফিরতে রাইত হইবো। একা থাকতে আপনের কোন সমস্যা হইবো নাতো?
-আরে না। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।
.
এরপর রমিজ চাচা ছাদ থেকে নেমে চলে গেলেন। আমি ছাদেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের ছাদ থেকে পাশের হরিনাথ বাংলোটা স্পষ্ট দেখা যায়।
এর আগেও অনেকবার দেখেছি ছাদ থেকে এই হরিনাথ বাংলোকে। কিন্তু এর আগে কখনো এতটা কৌতুহল নিয়ে দেখিনি। বাড়িটা দেখে আজ কেনো জানি খুব ভয় করছিলো। কোন এক অজানা মায়া আর রহস্য আমাকে বাড়িটার ভেতরে যেতে আহ্বান করছিলো। কিন্তু আমার সাহস হচ্ছিলো না সেই বাড়িতে একা যাওয়ার। তাও আমি অবাক দৃষ্টিতে সেই হরিনাথ বাংলোর দিকে ধ্যান ধরে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার ধ্যান ভেঙে গেল আমার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে। আমি চমকে উঠলাম! দ্রুত পেছনে তাকালাম। দেখলাম রমিজ চাচা দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে রমিজ চাচাকে প্রশ্ন করলাম,
-আরে চাচা! তুমি এখানে? তুমি না বললে যে পাশের গ্রামে যাবে?
-জ্যা বাবু। যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু কেন জানি আপনেরে একা রাইখা যাইতে ইচ্ছা করলো না। আপনে বাবু অনেক পাল্টাইয়া গেছেন। আপনের কিছু একটা হইছে আমি বুঝতে পারতাছি। আমি আপনের বাপের মতো। আপনি চাইলে আপনের সমস্যা আমারে কইতে পারেন।
রমিজ চাচার কথাগুলো শুনে আমি একটু চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর ভাবলাম।
না! আসলেই ঘটনাগুলো কারও সাথে শেয়ার করা উচিত। না হলে আমার মনের রহস্য আরো গভীর হতে থাকবে। আর হয়তো আমি এক সময় এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাগলই হয়ে যাবো।
তাই রমিজ চাচাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। সে রাতে রমিজ চাচার বেশে আসা লোকটার কথা, এই ডায়েরিটার কথা, মিশির পরিবারের কথা, হরিনাথ বাংলোর কথা সব কথা খুলে বললাম রমিজ চাচাকে।
চলবে....
লেখাঃ মোঃ শামীম শিহাব
Comments
Post a Comment