-হ্যাঁ। আমি মারা গেছি। আপনার সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি, এটা আমি না।
আমি তার কথার অর্থ কিছুই বুঝলাম না। এরপর সে ভয়ংকর ভাবে হাসতে শুরু করলো । যদিও অন্ধকারে আমি তাকে দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু তার ভয়ংকর হাসির শব্দ আমার শরীরের সব রক্ত জমিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছিলো। আমি অনেকটা ভয় নিয়েই মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম,
-হাসছেন কেনো? আর আপনি কি বলছেন এসব? আমি আপনার কোন কথার অর্থই বুঝতে পারছি না।
এরপর মেয়েটা হাসি থামিয়ে কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-এসব বুঝে আপনার কোনো কাজ নেই। আপাতত আপনার কাছ থেকে একটা সাহায্য চাই আমার।
-কি সাহায্য?
-একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। আমার আত্মাকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত করতে।
-আমি! কিন্তু কিভাবে?
-আমার স্বামী আর মেয়ের আত্মা মুক্তি পেয়েছিলো কারণ তারা নিষ্পাপ ছিলো। কিন্তু আমি পৈশাচিক শক্তির উপর বিশ্বাস করে পিশাচ মন্ত্র পড়তে শুরু করেছিলাম তাই আমার আত্মা অভিশপ্ত হয়ে গেছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে আমাকে এখন পিশাচ হতে হবে। এরপর যেই নরপশুগুলো আমার পরিবারের উপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছিলো তাদের খুন করে আমার প্রতিশোধ নিবো। এই প্রতিশোধ নিতে পারলেই আমার আত্মা পৃথিবী থেকে চিরো মুক্তি পাবে।
-বুঝলাম। কিন্তু আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি আপনার জন্য কোন খুন করতে পারবো না।
-আপনাকে কোন খুন করতে হবে না। আমার শুধু একটা মৃত শরীরের প্রয়োজন, যে শরীরে আমার অভিশপ্ত আত্মা প্রবেশ করবে। এরপর আমি সেই শরীর দিয়েই আমার সব প্রতিশোধ নিবো। আপনি শুধু আমাকে একটা লাশের ব্যবস্থা করে দিবেন।
-আপনার নতুন শরীর লাগবে কেনো? আপনিতো এইভাবেই প্রতিশোধ নিতে পারেন। যেভাবে আপনি আমার বাড়িতে রমিজ চাচার বেশে এসেছিলেন সেভাবেই তো তাদের কাছে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারেন।
-না। এই ক্ষমতা আমার বেশি নেই। আমার অভিশপ্ত আত্মা শুধু এই গ্রামেই থাকতে পারবে এর বাহিরে কোথাও যেতে পারবে না। আর এই আত্মার মাধ্যমে আমি পৈশাচিক শক্তি পাবো না। তাই আমার একটা মৃত শরীর লাগবে এবং সেটা আপনি আমাকে ব্যবস্হা করে দিতে পারবেন।
-কি বলছেন এসব? মৃত শরীর আমি কোথায় পাবো? এটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না। আপনি এখন এই দুনিয়ার মানুষ না। তাই আপনার এসব প্রতিশোধের কথা না ভেবে ওপারের দুনিয়ায় চলে যাওয়া উচিত। তাদের শাস্তি এমনিতেই হবে পরকালে।
-আমি আপনার কাছ থেকে এসব কথা শুনার জন্য আপনাকে এখানে নিয়ে আসিনি। আমার একটা মৃত শরীর চাইই। আপনি যদি এটা না করতে পারেন, তাহলে আপনার সাথে অনেক খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। আপনি এখন মারাও যেতে পারেন।
মেয়েটার মুখে এইসব কথা শুনে ভয়ে আমি পুরো চুপ হয়ে গেলাম। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে এখন আমার কি করা উচিত? অন্তত একটা মৃত শরীরতো আমার পক্ষে আনা পুরো অসম্ভব।
আর মেয়েটাকে যদি বলি যে আমি এই কাজ করতে পারবো না তাহলে সে আমার সাথে যেকোন কিছু করে ফেলতে পারে। পুরো বাংলোতে এখন শুধু মাত্র আমি আর সেই অশরীরী মেয়েটাই রয়েছি। আমি বুঝতে পারছিলাম যে , যে করেই হোক আগে আমাকে এই অভিশপ্ত বাংলো থেকে বের হতে হবে। কিন্তু কিভাবে বের হবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। মোবাইলটাও বন্ধ আর রমিজ চাচাও জানে না যে আমি এখন কোথায় আছি। হয়তো সে জানলে আমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারতো। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে এইগুলোই চিন্তা করছিলাম। এরপর সেই মেয়েটা আবার গম্ভীর কন্ঠে আমাকে বললো,
-চলুন বাড়ির উঠানে যাই।
অন্ধকারে কিছু না দেখা গেলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এই কথা বলার পর মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে উঠানের উদ্দেশ্যে। আমারও আর কিছু করার ছিলো না তাই তার সাথে সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে চলে গেলাম। অতিরিক্ত অন্ধকারের কারণে আমি চারিদিকে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। তাই চুপচাপ উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর মেয়েটাকে খুজছিলাম। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই মেয়েটা একটা মোমবাতি হাতে আমার সামনে এসে দাড়ালো। মোমবাতির আলোতে জাপসা করে মেয়েটার মুখ কিছুটা বোঝা যাচ্ছিলো। আমি মেয়েটার মুখ এই প্রথম দেখলাম। কিন্তু দেখে আমি আৎকে উঠলাম। মেয়েটাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো। এই মুখটা এর আগেও কোথায় যেনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ মনে পড়লো।
আরে! এটাতো সেই মেয়েটার মুখ যেটা আমি সেদিন রাত্রের ভয়ংকর স্বপ্নে দেখেছিলাম। এই মেয়েটাইতো সেদিন রাতে আমার ভয়ংকর স্বপ্নে এসেছিলো। আমি স্বপ্নে কবর খুড়ে যে ৩টা লাশ দেখেছিলাম তার মধ্যে মাঝখানের সেই ভয়ংকর লাশটা ছিলো এই মেয়েটারই লাশ! মেয়েটার মুখ দেখে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো। আমি ভাবছিলাম যে যদি সেদিনের স্বপের ঘটনা আজ বাস্তবে ঘটে তাহলে আমি কি করবো? সেদিন স্বপ্ন ছিলো বলে বেঁচে গেছি। কিন্তু এটাতো বাস্তব। এটা ভেবেই ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো। এরপর মেয়েটা আবার আমাকে বললো,
-ভয় পাবেন না। আপনার সাথে খারাপ কিছুই ঘটবে না। এই উঠানের গোলাপ গাছটার নিচে এখন আপনি মাটি খুড়বেন। এখানেই আমাকে,আমার স্বামী আর মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্হায় মাটি চাপা দিয়েছিলো সেই ডাকাতগুলো। আপনি এই কবরটা খুড়বেন। এরপর এই কবরের নিচে ৩টা মানুষের কঙ্কাল দেখতে পাবেন। মাঝখানের কঙ্কালের গলার দিকে দেখবেন এখনো একটা স্বর্নের চেইন রয়েছে। সেই চেইনটা আপনি আপনার কাছে নিবেন! কিন্তু সাবধান সেই কঙ্কালগুলোকে ছুবেন না। এরপর আবার কঙ্কালগুলোকে কবরে রেখেই মাটি চাপা দিয়ে দিবেন। এরপর যেভাবেই হোক এই হরিনাথ বাংলোতে একটা লাশ নিয়ে আসবেন আপনি। এরপর সেই লাশটার গলায় এই চেইনটা পড়িয়ে দিবেন। আপনার কাজ এখানেই শেষ। বিশ্বাস করুন এরপর আর আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। মুক্তি দিয়ে দিবো। আর আমার কথা মতো যদি আপনি কাজগুলো না করেন তাহলে আপনার সাথে যেকোন কিছু করে ফেলতে পারি আমি। হয়তো আপনার খুব প্রিয় মানুষটারও বড় ক্ষতিও করে দিতে পারি আমি!
মেয়েটার কথা শুনে ভয়ে আমি আর তাকে কিছু বলতে পারলাম না। এরপর মেয়েটা মোমবাতির আলো দিয়ে ইশারা করে আমাকে উঠানের একপাশে পড়ে থাকা একটা কোদাল দেখালো এবং বললো এই কোদাল দিয়ে সেই গোলাপ গাছটার নিচে খুড়তে। তখন ভয়ে তার কথা শুনা ছাড়া আমার আর কিছু করার সাহস ছিলো না। তাই চুপচাপ উঠান থেকে কোদালটা নিয়ে মৃত গোলাপ গাছটার নিচের কবরটা খুড়তে শুরু করলাম। এতো রাতে একটা কবর খুড়ছি এটা ভেবেই ভয়ে আমার হাত-পা পুরোই ঠান্ডা হতে লাগলো। মেয়েটা আমার থেকে কিছুটা দুরেই মোমবাতি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কবর খুড়ার মাঝেমাঝে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কি ভয়ংকর তার চোখের চাহনি। মনে হচ্ছে এখনই আমাকে জীবন্ত গিলে খাবে। আমি দ্রুত কবরটা খুড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার চোখে শুধু ভেসে আসছিলো সেদিন রাতের সেই ভয়ংকর কবরের দৃশ্যটা। আমি ভাবছিলাম এখন কবর খুড়ে যদি দেখি ভয়ংকর সেই ৩ টা তাজা লাশ রয়েছে! আর তারাও আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তাহলে আমি কি করবো! হয়তো ভয়েই মরে যাবো। ধীরে ধীরে কবর খুড়া প্রায় শেষ হয়ে গেলো।
চলবে....
লেখাঃ মোঃ শামীম শিহাব
Comments
Post a Comment