রাত এখন প্রায় ১১টা বাজে। নিজের বাড়ির উঠানে একা একা বসে আছি। হাতে একটা ভুতের গল্পের বই। বাড়িতে একা রয়েছি তার উপর আবার পূর্নিমার রাত। আবার চারিদিকে হালকা হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো। এরকম পরিবেশে ভূতের গল্প পড়া যে কি মজার তা শুধু যারা এই পরিবেশে বই পড়ে অভ্যস্ত তারাই বলতে পারবে। আমার বাড়িটা গ্রামের অনেক ভেতরে অবস্হিত। তাই বেশ নির্জন একটা বাড়ি। আশেপাশে অন্য আর কোন বাড়ি নেই। আমার বাড়ি থেকে একটু দুরেই শুধু পরিত্যাক্ত একটা বাংলো রয়েছে। বাংলোটার নাম হরিনাথ বাংলো। বাংলোটা দেখতে বেশ সুন্দর। যদিও এখানে এখন কেউ থাকে না।
বই পড়তে আমি ভীষণ ভালোবাসি। বিশেষ করে ভূতের বা কোন রহস্য গল্পের বই হলেতো আর কোন কথাই নেই। অবশ্য এই শেষ বয়সে আর কিইবা করতে পারি! আমার বয়স ৪০ পেরিয়ে ৫০ এর কাছাকাছি। এখন আর ঠিক আগের মতো কাজ করতে পারি না। অবশ্য কাজই বা করবো কাদের জন্য! এই পৃথিবীতে যে আমি বড় একা। খুবই একা। আমার কোন আপনজন আর বেঁচে নেই। সবাই ওপারের দুনিয়ায় পারি দিয়েছে।
আমার জন্মের ৩ মাস আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার বাবা মারা যান। আর আমার জন্মের সাথে সাথেই আমার মা মারা যায়। এরপর থেকে আমাকে আমার বড় ভাই রহিম শেখ লালন-পালন করে বড় করেন। কিন্তু আমার যখন ১৭ বছর বয়স তখন এক রাতে নৌকা ডুবিতে আমার সেই বড় ভাইও মারা যায়। পুরো পৃথিবীতে আমি বড় একা হয়ে যাই। ঠিক সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমার দেখাশোনা করতে থাকেন রমিজ চাচা। রমিজ চাচা আমার রক্তের সম্পর্কে কেউ না। আমাদের বাড়িতে টুকটাক কাজ করতো। আমার বাবা এবং বড় ভাইয়ের খুব বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিলো। রমিজ চাচার এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর আপন কেউ বেঁচে নেই। যদিও তার মা এখান থেকে অনেক দুরে একটা গ্রামে থাকেন। রমিজ চাচা আমাকে তার সন্তানের মতোই ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। রমিজ চাচা আমারো খুব বিশ্বস্ত। এরপর আমার যখন ২৭ বছর বয়স হয় তখন রেহেনা আক্তার নামে একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়। এরপর থেকে আমার জীবন খুব ভালোভাবেই চলছিলো। আমার তখন বয়স ৩৫। তখন আমার একটা ৫ বছরের ছেলেও ছিলো। নাম তার ছিলো রাফি। একরাতে আমি, রেহেনা আর রাফি গাড়ি করে এক দাওয়াত থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয়। আমি কোনভাবে সেই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাই। কিন্তু রাফি আর রেহেনাকে কোনভাবেই বাঁচাতে পারিনি। এরপর থেকে এই পৃথিবীতে আমি একা। বড় একা। এরপর থেকে নির্জন এই বাড়িতে থাকতে শুরু করি। এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বলই এই বইগুলো।
আর আমার দেখাশোনা করার দায়িত্বটা নেন এই রমিজ চাচা। তাই এখন আমি আর রমিজ চাচাই শুধু এখানে থাকি।
সব ছেড়ে এই বাড়িতে চলে আসারো একটা কারণ আছে। এই বাড়ির উঠানের পাশে ৫ টা কবর রয়েছে। এইগুলো আমার বাবা,মা, ভাই, স্ত্রী ও ছেলের কবর। এদের কবরের পাশে আরেকটা কবরের জায়গাও রাখা আছে। আমার ইচ্ছা কবরটা আমার হবে। তাই প্রতি রাতেই উঠানে বসে আমি গল্পের বই পড়তে বসি। মাঝেমধ্যে মনে হয় তারা আমার পাশেই আছে।
প্রতিদিনই আমার পাশে এখানে রমিজ চাচা থাকে। কিন্তু আজ সেও বাড়িতে নেই। তাই আমি একা। আসলে হঠাৎ গতকাল রমিজ চাচা খবর পায় যে তার মা নাকি মারা গেছে। তাই রমিজ চাচা তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন গতকাল। যাওয়ার আগে বলে গেছেন ফিরতে ৩-৪ দিন লাগবে। আমিও তাকে আটকাইনি। যদিও রমিজ চাচাকে ছাড়া থাকার অভ্যাস আমার খুব একটা নেই। বসে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম আর রমিজ চাচার কথা মনে করছিলাম। সে এখন এখানে থাকলে হয়তো আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াতো।
.
সব চিন্তা বাদ দিয়ে বইটার দিকে আবার মনোযোগী হলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার মনোযোগটা নষ্ট করে দিলো একটা তাজা গোলাপের গন্ধ। আমি বেশ অবাক হলাম। এতোরাতে এখানে গোলাপের গন্ধ আসলো কিভাবে! আমার বাড়িতেতো আমি একা
রয়েছি। আর পুরো বাড়িতে কোন গোলাপের পারফিউম নেই। আর গোলাপ গাছ! আমাদের গ্রামতো দুরে থাক আশেপাশের চৌদ্দ গ্রামের ভেতর কোন গোলাপ গাছ নেই!
হঠাৎ গোলাপের গন্ধে বেশ অবাকই হলাম। হঠাৎ আমার অবাক দৃষ্টিকে আরো অবাক করে দিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হলো রমিজ চাচা। আমি রমিজ চাচাকে দেখে খুব অবাক হলাম। চাচারতো এখন তার গ্রামে থাকার কথা! সে এখন এখানে কি করছে! আমি অবাক হয়ে রমিজ চাচাকে প্রশ্ন করলাম:-
-রমিজ চাচা! তুমি এতো রাতে? তোমার না মা মারা গেছে? তোমারতো এখন গ্রামে থাকার কথা ছিলো?
-জ্যাঁ বাবু। মায়ের দাফন আজ সকালেই দেওয়া হইয়া গেছে। আপনারে ছাড়া মনটা কেমন যেনো করতাছিলো। তাই দাফন শেষ কইরাই চইলা আসছি। সেখানেতো আর আমার আপন কেউ নাই।
-তা যা বলেছো। তোমাকে ছাড়াও আমার খুব একা লাগছিলো। এসে যখন পড়েছো। ঘরে চলে যাউ। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে আবার কথা হবে।
-জ্যাঁ বাবু। আচ্ছা একটা কথা কইতে চাইছিলাম যে।
-কি কথা? বলো।
-আসলে বাবু, আমি ট্রেনে কইরা এইখানে আসতেছিলাম। ট্রেন যখন প্রায় এই স্টেশনে আইসা পৌছাইলো, তখন আমার লগে একটা মাইয়াও ট্রেন থিকা নামছিলো। মাইয়াটা আমারে একটা ডায়েরি দিয়া কইলো যে ডায়েরিটা একটু ধরতে। সে একটু পরেই আইসা নিয়া
যাইবো। এরপর মাইয়াটা পাশের একটা জঙ্গলে চইলা গেলো। আমি ভাবলাম হয়তো কোন টয়লেটে গেছে। তাই এক ঘন্টা ধইরা সেইখানে মাইয়াটার লাইগা দাড়াইয়া ছিলাম। কিন্তু জঙ্গল থিকা আর কেউ বাহির হইয়া আসে নাই। এরপর আমি জঙ্গলে গেলাম কিন্তু কাউরে খুইজা পাইলাম না। এরপর আর কিছু না বুইঝা ডায়েরিটা লগে কইরা নিয়া আইছি। আমিতো মূর্খ মানুষ কি লেখা আছে পড়তে পারি না। তাই ডায়েরিটা আপনেই রাখেন।
-কোথায় ডায়েরিটা, দেখি?
রমিজ চাচা তার পটলা(ব্যাগ) থেকে একটা ডায়েরি বের করে আমাকে দিলেন। ডায়েরিটা দেখেই বুঝতে পারলাম যে ডায়েরিটা খুব পুরাতন একটা ডায়েরি। হয়তো কারো ব্যাক্তিগত কথা লেখার ডায়েরি। কারো অনুমতি ছাড়া তার ব্যাক্তিগত ডায়েরি পড়া উচিত হবে না। তাই ডায়েরিটা রমিজ চাচার কাছ থেকে নিয়ে উঠানের পাশে থাকা একটা টেবিলে রাখলাম। রমিজ চাচাকে বললামঃ
-আচ্ছা পরে পড়ে নিবো আমি।
রমিজ চাচা আমার কথা শুনে বললেনঃ
-ঠিক আছে বাবু। আচ্ছা আপনার জন্য কি চা বানাইয়া নিয়া আসবো?
-তোমার হাতের চা না খেলেতো আমার রাতে ঘুমই হয় না চাচা। কিন্তু তুমিতো মাত্র কত দুর থেকে আসলে। থাক, আজ বাদ দাও।
-কি যে বলেন বাবু! চা বানাইতে আর কতক্ষন সময় লাগবো। আপনি বসেন একটু। আমি চা বানাইয়া নিয়া আসতেছি।
রমিজ চাচা চা বানাতে বাড়ির ভেতরে গেলেন। রমিজ চাচা এতো দ্রুত গ্রাম থেকে চলে আসায় মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। আসলে তাকে ছাড়া আমি খুব একটা থাকতে পারি না। এরপর আবার উঠানের চেয়ারে বসে সেই ভূতের গল্পের বই পড়তে শুরু করি। সেই ডায়েরিটা আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে টেবিলেই পরেছিলো। ডায়েরিটা সম্পর্কে এতোটাও আগ্রহ ছিলো না আমার। আমি টানা এক ঘন্টা মনোযোগ দিয়ে সেই বইটাই পড়তে থাকলাম। হঠাৎ আমার মনে পড়লো। আরে! রমিজ চাচা না সেই কখন গেলো চা বানাতে? তারতো এতক্ষন সময় লাগার কথা না। তাহলে কি রমিজ চাচা চা বানানোর কথা ভুলে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য রমিজ চাচা ভুলে যাওয়ার মানুষ না। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ খটকা লাগলো। তাই বইটা টেবিলে রেখে রমিজ চাচাকে খুজতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। আমি জোরে জোরে শব্দ করে তাকে ডাকছিলামঃ
-রমিজ চাচা। রমিজ চাচা। কোথায় তুমি? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? রমিজ চাচা?
কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে কোন উত্তরই এলো না। এরপর আমি পুরো বাড়ি খুজলাম কিন্তু কোথাও রমিজ চাচাকে খুজে পেলাম না। আমি খুব অবাক হলাম। রমিজ চাচা কি উধাও হয়ে গেলো নাকি? আমি আরো কয়েকবার রমিজ চাচাকে ডাকতে ডাকতে পুরো বাড়ি তাকে খুজলাম। কিন্তু তাকে কোথাও খুজে পেলাম না।
চলবে......
লেখাঃ মোঃ শামীম শিহাব
Comments
Post a Comment